‘আতা’
বাংলাদেশের একটি সাধারণ ফল হিসেবে পরিচিত। এই ফলের গাছটি বসতবাড়ির
আঙিনায়, ঝোপঝাঁড়ে
সহজেই জন্মে থাকে। আতা গাছ উচ্চতায় শরিফার চেয়ে একটু বড়।
আতা দেখতে অনেকটা হৃৎপিন্ডের আকৃতির মত এবং এই ফলের আকার শরিফার চেয়ে বড় ও
মসৃণ চর্মযুক্ত। অযত্নে অবহেলায় আতাফলের বংশ বিস্তার হয়ে থাকে, ফলও ধরে
সহজে। স্বাদে শরিফার চেয়ে একটু কম। গ্রামের কোন কোন বাড়িতে দুই একটি আতা
গাছ দেখা যায়। আবার কোন কোন এলাকায় এটি নোনা ফল নামেও পরিচিত। স্বাদের দিক
থেকে কিছুটা নোনতা হওয়ার কারণে এর নামকরণ এমনটি হয়েছে মনে হয়। হিন্দিতে এর
নাম ‘রাম ফল’ বলে থাকে। আমেরিকার উষ্ণ মন্ডল ও পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ”
আতার আদি নিবাস আছে।
পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ফলটি সহজে পেট ভরাতেও দারুণ
সাহায্য করে। অনেকের কাছে আতা খুব পছন্দের ফল। সহজলভ্য এ ফলটির প্রতি ১০০
গ্রামে পাওয়া যাবে শর্করা ২৫ গ্রাম, পানি ৭২ গ্রাম, প্রোটিন ১.৭ গ্রাম,
ভিটামিন এ ৩৩ আইইউ, ভিটামিন সি ১৯২ মিলিগ্রাম, থিয়ামিন ০.১ মিলিগ্রাম,
রিবোফ্লাবিন ০.১ মিলিগ্রাম, নিয়াসিয়ান ০.৫ মিলিগ্রাম, প্যানটোথেনিক অ্যাসিড
০.১ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩০ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.৭ মিলিগ্রাম,
ম্যাগনেসিয়াম ১৮ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ২১ মিলিগ্রাম, পটাসিয়াম ৩৮২
মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ৪ মিলিগ্রাম। আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে সহায়ক ভূমিকা
পালন করে গুণে ভরা আতাফল। চলুন জেনে নেই সাধারণ আতা ফলের অসাধারণ ঔষধি গুণ ও
উপকারিতা সম্পর্কে।
আতাফলের ঔষধি গুণ
- আতাগাছের শেকড়ের ছাল আমাশয়ের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- আতাফলের শাঁসের রস রক্তের শক্তি বৃদ্ধিকারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- অপুষ্টিজনিত সমস্যায় আতাফলের রসের সাথে দুধ মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
- যে ফোঁড়া পাকেও না আবার বসেও না, এমন ফোঁড়ায় আতার বীজ বা পাতা বেটে সামান্য লবণ মিশিয়ে প্রলেপ দিলে ফোঁড়া পেকে পুঁজ বের হয়ে যায়।
- পাতার রস উকুননাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আতাফলের নানান উপকারিতা
১। আমাশয়ে
আতা
গাছের মূলের ছালের রস ২০/২৫ ফোঁটা ৭/৮ চা চামচ দুধ সহ খেতে হবে, তবে
ছাগলের দুধ হলে ভাল হয়। আথবা আতা গাছের মূলের ছাল চূর্ণ ২০০ মিলিগ্রাম
একবার বা দুইবার খেতে হবে। এর দ্বারা ২/৩দিনের মধ্যে আমাশয় ভালো হয়ে
যাবে।
২। রক্তে নিস্তেজ ভাব কমে গেলে
ঠান্ডার
কোনো ব্যধি না থাকলে তাহলে পাকা আতাফলের শাঁসের রস ২/৩ চা চামচ করে সকালে ও
বিকালে ২ বার খেলে রক্তের নিস্তেজ ভাবটা সেরে যায়। আবার যদি রস করা সম্ভব
না হয় তাহলে পাকা আতা এমনি খেলেই চলবে।
৩। অপুষ্টিজনিত কৃশতায়
শিশু,
যুবক যুবতী বৃদ্ধ যে কোনো বয়সেরই হোক এ ক্ষেত্রে পাকা আতাফলের রস ২/৩ চা
চামচ করে একটু দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়ালে ধীরে ধীরে পুষ্টি সঞ্চার হয়
এবং কৃশতাও দূর হয়। অপুষ্টিজনিত কৃশতায় আতা ফলের রস অনেক উপকারি।
৪। রক্তপিত্তজনিত দাহরোগে
আতাফলের
শাঁসের রস রক্তের শক্তি বৃদ্ধিকারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অল্প রক্তচাপের
কারনে মাঝে মাঝে বমির সংগে রক্ত বের হয় আবার বন্ধ হয়ে স্বাভাবিক মনে হয়,
আবার কারো কারো আগ্নির বলও থাকেনা। এ ক্ষেত্রে পাকা আতার রস ২/৩ চা চামচ
করে খাওয়ালে সেরে যাবে।কারো কারো দেহে সর্বোদা একটা দাহ ভাব আসে তাদের
জন্য আতাফল খেলে সেটাও চলে যাবে।
৫। ফোঁড়ায়
যে
ফোঁড়া দড়কচা যাকে বলে পাকছেওনা বসছেওনা। না কাঁচা না পাকা এ ক্ষেত্রে
আতার বীজ বা পাতা বেটে সামান্য লবন মিশিয়ে প্রলেপ দিলে ফোঁড়া পেকে ফেটে
পুঁজ বের হয়ে যাবে। ফোঁড়ার ক্ষেত্রে আতাফলের বীজ বা পাতা অনেক উপকারি।
৬। ক্ষতের পোকায়
পিত্তশ্লেষ্মাপ্রধান
শরীরে ক্ষত হলে তাড়াতাড়ি শুকাতে চায়না। দীর্ঘদিন থাকলে পোকা জন্মে।সে
ক্ষেত্রে কাঁচা আতাফল বীজসমেত শুকিয়ে মিহি গুড়া করে ঐ ক্ষতে ছড়িয়ে দিলে
ক্ষতের কীট মরে যাবে এবং ঘাও শুকিয়ে যাবে। তবে এই গুড়ো দেবার আগে
কালমেঘের পাতা সিদ্ধ পানি দিয়ে ঐ ক্ষতটা ধুয়ে নিলে আরো তাড়িতাড়ি সেরে
যাবে।
৭। মূর্ছা রোগে
অনেক
সময় মাসিক ঋতুর দোষে মূর্ছা রোগ হয়। এই রোগাক্রমন হলে সেই সময় আতাপাতার
রস ২/১ ফোঁটা নাকে দিলে ২/৩ মিনিটের মধ্যে মূর্ছা ভেঙে যায়। রস দেয়ার
সময় ড্রপারে করে দিতে হবে। দেখবেন খুব দ্রুত ভাল হয়ে যাবে।
৮। উকুনে
মাথায়
উকুন হলে নির্বংশ করতে আতাপাতার রস ২ চা চামচ তার সঙ্গে ২/১ চা চামচ পানি
মিশিয়ে চূলে লাগিয়ে কিছুক্ষণ রাখলে উকুন মরে যাবে।একদিনে না গেলে ২/৩ দিন
পর আবার লাগাতে হবে। এ ছাড়া পাতা বেটে লাগালেও উকুন মরে যাবে। তবে
সাবধানে ব্যবহার করতে হবে যেন চোখে না লাগে, তাহলে চোখ জ্বালা করবে ও লাল
হয়ে যাবে।তাছাড়া এই রস লাগানোর পর মাথা ঘুরতে থাকলে না লাগানো উচিৎ।তবে
প্রথমে আধা চামচ পানি মিশিয়ে লাগিয়ে দেখা ভালো।
৯। রোগ-প্রতিরোধে
আতাফলে
থাকা উচ্চমাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী
করে। দুরারোগ্য ব্যাধিকে তাড়িয়ে আপনাকে সুস্থ রাখতেও সাহায্য করে। এছাড়া
আতাফলের খাদ্যউপাদান এনিমিয়া প্রতিরোধ করে থাকে।
১০। হাড় মজবুত করতে
আতা
ফলে প্রচুর ক্যালসিয়াম বিদ্যমান। আর শরীরের হাড় গঠন ও মজবুত রাখার জন্য
পর্যাপ্ত পরিমানে ক্যালসিয়াম সরবারহ করতে সক্ষম এই আতা ফলটি। তাই হাড়
মজবুত করতে আতা ফল খাওয়া উচিত।
১১। হজম শক্তি বৃদ্ধিতে
খাবারের
হজম শক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে আতাফলে থাকা ফসফরাস উপকারী ভূমিকা পালন করে। এর
খাদ্যআঁশ হজমশক্তি বৃদ্ধি করে ও পেটের সমস্যা দূর করে। তাই যাদের হজমের
সমস্যা তারা এই আতা ফল খেলে অনেক উপকার পাবেন।
১২। খনিজ পদার্থসমূহ সরবরাহে
আতাফল শরীরের ডিএনএ ও আরএনএ সংশ্লেষণ, শক্তি উৎপাদনের জন্য ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন সি ও খনিজ পদার্থসমূহ সরবরাহ করে থাকে।
১৩। দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে
আতাফলে
রিবোফ্লাভিন ও ভিটামিন সি আছে। আর এই ভিটামিন উপস্থিতির কারণে দৃষ্টিশক্তি
বাড়ে। সেক্ষেত্রে আতা ফল অনেক সহায়ক। যাদের চোখের সমস্যা তারা আতা ফল
খাবেন, এতে আপনার চোখের উপকার হবে।
১৪। চুল ও ত্বকের যত্নে
আতা
ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, যা একটি উন্নতমানের
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ফ্রি রেডিক্যাল নিয়ন্ত্রণে রক্ষা করে। এছাড়া ত্বকে
বার্ধক্য বিলম্বিত করে। এতে উপস্থিত ভিটামিন এ চোখ, চুল ও ত্বকের জন্য
খুবই উপকারী।
১৫। হৃৎপিন্ডের রোধে
আতা
ফলের ম্যাগনেসিয়াম মাংসপেশির জড়তা দূর করে এবং হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়তা
করে। এর পটাশিয়াম ও ভিটামিন বি৬ রক্তের উচ্চচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং হৃদরোগ ও
স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
আতা ফলের অপকারিতা
কোনো গর্ভবতী নারীর আতার পাতা বা বীজ কোনো কিছুই ব্যবহার করা উচিৎ নয়। এতে গর্ভের ক্ষতি হয়ার সম্ভবনা থাকে।
শরিফা ফলের সম্পর্কে কিছু পরিচিতি
অনেকে
আতা বা শরিফা ফলের মধ্যে পার্থক্য পায় না। শরিফা বা মেওয়া ফল দেখতে ঢেউ
খেলানো এবং অত্যন্ত মিষ্টি ও সুস্বাদু। শরিফা ইংরেজীতে কাস্টার্ড
অ্যাপল,সুগার অ্যাপল,সুইট অ্যাপল এসব নামে পরিচিত। দক্ষিণ আমেরিকার
নিরক্ষীয় অঞ্চলে শরিফা প্রচুর পরিমাণে জন্মে। মনে করা হয় যে, কলম্বাসের
আমেরিকা আবিষ্কারের অনেক আগেই পর্তুগীজরা প্রশান্ত মহাসাগরীয় কোন দ্বীপ
থেকে ভারতবর্ষে শরিফা নিয়ে আসেন। বর্তমানে বাংলাদেশ,ভারত,পাকিস্তান ছাড়াও
চীন,ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ ”, কিউবা,মধ্য
আফ্রিকা,মিসর,শ্রীলঙ্কা,মায়ানমার,থাইল্যান্ড,আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র,পশ্চিম
ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ”, অস্ট্রেলিয়া এবং গ্রীষ্ম প্রধান সকল স্থানেই শরিফা
পাওয়া যায়। উপার্জনের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে, তাতে সন্দেহের কোন
অবকাশ নেই। কীটনাশক হিসেবে আতা ও শরিফার বিভিন্ন অংশ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর
মধ্যে অপরিপক্ক ফল,বীজ,পাতা ও শেকড়ের মধ্যে রয়েছে কীটনাশকের মূল উপাদান।
বীজে তেলের পরিমাণ শতকরা ৪২-৪৫ ভাগ। গাছের পাতা,বীজ ও অপরিণত শুকনো ফলের
মিহি গুড়া কীটনাশক দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।স্পর্শ ও পাকস্থলী বিষ হিসেবে
আতা ও শরিফা গাছের বিভিন্ন অংশ কাজ করে। এটি শুধু কীটনাশক হিসেবেই নয় কীড়া
নাশক, বিতাড়ক ও খাদ্য নিরোধক হিসেবেও কাজ করে। ধানের বাদামী ঘাস ফড়িং,সবুজ
গান্ধী পোকা, সবুজ পাতা শোষক পোকা,সাদা পিঠ পাতা শোষক পোকা,আলুর জাব
পোকা,শাকসবজির জাব পোকা,শসা-কুমড়ার লাল পোকা ও বাঁধা কপির ডায়মন্ড ব্যাক মথ
এসব পোকা দমনে এদুটি ফল গাছের অংশসমূহ ব্যবহার করা হয়। আতা ও শরিফার বীজ
থেকে নিষ্কাশিত তেল(১০%ঘনত্বে) এক জাতীয় গান্ধি পোকার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে
৭২ ঘন্টার মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ পোকা মারা সম্ভব হয়েছে। চীন ও ফিলিপাইনে
মানুষের মাথার উকুন দমনের জন্য আতা ও শরিফার বীজের গুড়া ব্যবহৃত হয় বলে
জানা গেছে। ইথার সহযোগে পাতার নির্যাস ব্যবহারের ফলে শতকরা ৯১ ভাগ
শসা-কুমড়ার লাল পোকা দমন সম্ভব হয়েছে।আতা ও শরিফা থেকে তৈরী বিষের
কার্যকারিতা ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। এ বিষ ব্যবহারের পর ২-৩ দিন পর্যন্ত
সময়ের প্রয়োজন হয়্ । পরীক্ষাগারে পরীক্ষায় দেখা গেছে ,ইথার বা পেট্রোলিয়াম
ইথার’র সাহায্যে বীজ থেকে রস বের করলে তার বিষাক্ততার মাত্রা ৭০-১০০ গুণ
পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আতা বা শরিফার বীজ গুড়া করার সময় একটি বিষয়ে বিশেষ
সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে এই গুড়া কোনভাবে যেন চোখের সংস্পর্শে না
আসে। এই গুড়া চোখের সংস্পশেৃ এলে সেখানে মারাত্মক ব্যথা বা তের সৃষ্টি হতে
পারে। সুতরাং ফেলে দেওয়া ফল হিসেবে নয়, পরিবেশ বান্ধব ও কৃষকের সাশ্রয়ী
কীটনাশক হিসেবে আতা ও শরিফার বাণিজ্যিক ভিত্তিক চাষ মানব দেহ ও সংসারের
জন্য অনেক উপকারি।
No comments:
Post a Comment