সুস্বাদু সবজি হিসেবে কুমড়োর কোন তুলনা হয় না। কুমড়ো আমাদের অনেকেরই খুব
প্রিয় সবজি। মিষ্টি কুমড়ার মতো সুস্বাদু সবজি খুব কমই রয়েছে। হালকা মিষ্টি
স্বাদের এই সবজিটি পাওয়া যায় সারা বছর জুড়ে। ভিটামিন-এ তে ভরপুর কুমড়ো
আমাদের দেহের জন্যও উপকারী।
কুমড়ো দিয়ে ভাজি থেকে শুরু করে আচার, নিরামিষ,
মাংস রান্না সব কিছুই করা হয়ে থাকে। আমরা সবাই জানি সবজি হিসেবে কুমড়ো
আমাদের দেহের নানারকমের পুষ্টির যোগান দিয়ে থাকে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে
অক্টোবরের শেষে মিষ্টি কুমড়ার চাহিদা থাকে ভীষণ। কারণ মিষ্টি কুমড়া বা
Pumpkin দিয়ে তৈরি করা হয় হ্যালোইনের বিশেষ বাতি। খাদ্যতালিকায় নিয়মিত
মিষ্টি কুমড়ার উপস্থিতি আপনাকে রাখতে পারে অনেক অসুখ-বিসুখ থেকে দূরে।
কেননা মিষ্টি কুমড়া এমন একটি সবজি, যার রয়েছে নানাবিধ পুষ্টিগুণ। শুধু
তরকারি হিসেবেই নয়, অন্যান্য ফলের মতো মিষ্টি কুমড়া ব্যবহার করতে পারেন
সালাদ বা স্যুপ তৈরিতেও।
কুমড়োতে আছে ভিটামিন-এ, বি-কমপ্লেক্স, সি,
ই, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, জিংক, ফ্লেভনয়েড পলি-ফেনলিক,
অ্যান্টিঅক্সিডেণ্ট উপাদান সমূহ যেমন লিউটিন, জ্যানথিন এবং আরও অনেক
উপাদান। কুমড়োতে ক্যালোরিও বেশ কম থাকে। কিন্তু আপনি জানেন, এসব ছাড়াও
কুমড়োর এমন কিছু গুণাগুণ আছে যা আপনাকে অবাক করবে। চলুন আজ জেনে নেই কুমড়োর
অবিশ্বাস্য স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে।
ওজন কমাতে সাহায্য করে
কুমড়োতে
ক্যালরির পরিমাণ অনেক কম কিন্তু এতে ফাইবার ও পটাশিয়াম আছে প্রচুর
পরিমানে। কুমড়োর ফাইবার উপদান আমাদের দেহের ক্ষুধা নিয়ন্ত্রন করে থাকে।
পটাশিয়াম আমাদের দেহ থেকে অপ্রয়োজনীয় পানি ও লবণ বের করে ওজন নিয়ন্ত্রণে
রাখতে সাহায্য করে। তাই চাইলে প্রতিদিন কুমড়ো জুস করে খেতে পারেন ওজন
নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।
চোখের অসুখ প্রতিরোধে
মিষ্টি
কুমড়াতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ। বিটাক্যারোটিন সমৃদ্ধ এই সবজিটি
তাই চোখের জন্য খুবই ভালো। বয়সজনিত রোগ বিশেষ করে রেটিনার বিভিন্ন অসুখ
প্রতিরোধে মিষ্টি কুমড়া বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শুধু চোখের অসুখ নয়,
ভিটামিন এ-এর অভাবজনিত অন্যান্য রোগেও মিষ্টি কুমড়া উপকারী। কুমড়োতে আছে
এমন একটি উপদান যার নাম ক্যারটিনয়েড এবং এই উপদানটিচোখে ছানি পড়া ও যেকোন
বয়সে চোখের সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে থাকে। কুমড়ো আমাদের দেহের
সুস্থ ত্বক গঠনে সাহায্য করে থাকে ও দেহে টিস্যু তৈরি করতেও সহায়তা করে
থাকে। তাই দেরি না করে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কুমড়ো রাখুন।
হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে
পুষ্টি
ও ফাইবারে ভরপুর কুমড়ো খেলে দেহের হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়। কুমড়ো আমাদের
দেহের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, ডায়রিয়া সমস্যায় দূর করতে সাহায্য করে এবং
কাঁচা কুমড়োর রস আমাদের দেহের এসিডিটি সমস্যা রোধ করে। আপনি সবসময় সুস্থ
থাকতে চইলে এক গ্লাস কুমড়োর জুসের সাথে সামান্য মধু মিশিয়ে ৩ বেলা খেতে
পারেন। কিন্তু এই জুস যেকোন ভারী খাবার খাওয়ার ৩০ মিনিট আগে খেতে হবে।
ক্যান্সার প্রতিরোধে কুমড়োর গুরুত্ব
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
সমৃদ্ধ মিষ্টি কুমড়া ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়া
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোলেস্টেরল কম রাখতে সাহায্য করে। আর্টারির দেয়ালে
চর্বির স্তর জমতে বাধা প্রদান করে। ফলে মিষ্টি কুমড়া নিয়মিত খেলে হৃদরোগও
প্রতিরোধ করা যায়।
রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে
মিষ্টি
কুমড়াতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। আরো আছে প্রচুর পরিমানে
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন-এ, সি, ই, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম এবং অনেক
উপাদান। কারন মিষ্টি কুমড়ো হল বিভিন্ন ধরণের ভিটামিনের ভাণ্ডার। যা রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলে সর্দি-কাশি, ঠাণ্ডা লাগা প্রতিরোধ করতে
সাহায্য করে। মিষ্টি কুমড়ার ভিটামিন এ ও সি চুল ও ত্বক ভালো রাখে। তাই
চকচকে উজ্জ্বল চুল ও সুন্দর ত্বকের জন্য নিয়মিত মিষ্টি কুমড়া খেতে পারেন।
আর বিশেষ করে কুমড়োর উপাদান বিটা-ক্যারোটিন আমাদের দেহের রোগ-প্রতিরোধ
ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
দেহের জ্বালাপোড়া সমস্যা দূর করতে
কুমড়োর
ক্যারটিনয়েড এর জন্য রং উজ্জ্বল কমলা হয়ে থাকে এবং এটি দেহের জ্বালাপোড়া
সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে থাকে। এই সবজির বিটা-ক্যারোটিন উপাদান আমাদের
দেহের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে, আলফা-ক্যারোটিন উপদান দেহে টিউমার হওয়া
থেকে রক্ষা করে। কুমড়োর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিন-ই আমাদের দেহকে
ক্যান্সার ও আজঝেইমার রোগ হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
ত্বক সুরক্ষা করতে ও বয়স কম দেখাতে
গাজরের
তুলনায় মিষ্টি কুমড়াতে অধিক পরিমাণে বিটাক্যারোটিন। গাজরে যেখানে ১৩
মিলিগ্রাম বিটাক্যারোটিন রয়েছে, মিষ্টি কুমড়াতে রয়েছে ৩৩ মিলিগ্রাম
বিটাক্যারোটিন। বিটাক্যারোটিন এক ধরনের শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
শরীরের ফ্রি রেডিকাল ড্যামেজ প্রতিরোধে মিষ্টি কুমড়া ভূমিকা পালন করে।
বিভিন্ন দূষণ, স্ট্রেস ও খাবারে যে সব কেমিক্যাল ও ক্ষতিকর উপাদান থাকে
সেগুলোর কারণে ফ্রি রেডিকাল ড্যামেজ হতে শুরু করে। ফ্রি রেডিকাল ড্যামেজের
ফলে শরীরের ভালো কোষগুলো নষ্ট হতে শুরু করে এবং খারাপ কোষের সংখ্যা বাড়তে
শুরু করে। ভিটামিন-এ ত্বককে সুরক্ষা করে এবং সূর্যের তাপে আমাদের ত্বকের
যেই সমস্যা হয়ে থাকে তা রোধ করে বিটা-ক্যারোটিন। সবুজ, কমলা, হলুদ রঙের
সবজিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বেশি পরিমাণে থাকে। তাই মিষ্টি কুমড়া ফ্রি
রেডিকাল ড্যামেজ প্রতিরোধ করতে পারে। ভিটামিন-বি ও সি ত্বকের কোলাজেন
উৎপাদনে সাহায্য করে, ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে ও স্বাস্থ্যবান চামড়া
তৈরিতে সহায়তা করে। ভিটামিন বি5 ত্বকের যেকোন দাগ দূর করতে সাহায্য করে।
গর্ভবতী নারীর জন্য কুমড়ো
যে
কোন নারীর গর্ভকালে কুমড়ো খাওয়া উচিত কারণ এটি দেহে অনেক বেশি শক্তি যোগায়
ও গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যের জন্য কুমড়ো অনেক উপকারী খাদ্য। এটি
পাশাপাশি হজম শক্তি বৃদ্ধি করে ও কুমড়োর আয়রন বাচ্চাকে অক্সিজেন দিতে
সাহায্য করে ও মায়ের রক্তশূন্যতা রোধ করে।
ব্যায়ামের পর কুমড়োর জুসের গুণ
ব্যায়াম
করার পর আপনি খাদ্য হিসেবে কুমড়ো খেতে পারেন এবং সাথে মিষ্টি আলুও খেতে
পারেন। এই খাবার আমাদের দেহে প্রয়োজনীয় কার্বোহাইড্রেট এর যোগান দিয়ে থাকে।
কুমড়াকুমড়ো আমাদের দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে তো রাখেই পাশাপাশি দেহের সুস্থ
পেশি তৈরিতেও সাহায্য করে। যারা সাধারণত অ্যাথলেটিক ট্রেনিং নিয়ে থাকেন
তাদের জন্য কুমড়ো বেশি করে খাওয়ার উপকারিতা অনেক বেশি।
উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে আনতে
কুমড়োতে
আছে প্রচুর পরিমানে পটাশিয়াম উপাদান যা আমাদের দেহের উচ্চ রক্তচাপ
নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে থাকে এবং ভিটামিন-সি ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে
রাখতে সহায়তা করে থাকে। তাছাড়া কুমড়োর বিভিন্ন উপাদান আমাদের দেহের কিডনি,
লিভার, হার্টকে সুস্থ রাখে। কুমড়োর ফাইবার দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক
রেখে আমাদের দেহকে স্ট্রোক করার ঝুঁকি থেকে রক্ষা
দেহের উর্বরতা বৃদ্ধিতে
কুমড়ো
ও এর বীজে আছে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স যা আমাদের দেহের উর্বরতা বৃদ্ধি করতে
সহায়তা করে। কুমড়োর ভিটামিন-ই উপাদান নারী ও পুরুষ উভয়ের দেহের উর্বরতা
শক্তি বৃদ্ধি করে থাকে ও আমাদের দেহর কোষকে বিষাক্ত পদার্থ থেকে রক্ষা করে।
এই সবজি পুরুষদের সুস্থ শুক্রাণু তৈরিতে সাহায্য করে ও নারীদের জরায়ু জনিত
কোন সমস্যা থাকলে তা রোধ করতে সাহায্য করে থাকে। কুমড়োর বীজে আরও আছে
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড যা দেহের উর্বরতা ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। কুমড়ো প্রজনন
অঙ্গে রক্ত প্রবাহ করে, হরমোন নিয়ন্ত্রন করে ও মানসিক চাপ দূর করে।
মিষ্টি কুমড়োর বিচির অনন্য স্বাস্থ্য উপকারিতা
মিষ্টি
কুমড়ো আমাদের কাছে অনেক প্রিয় একটি সবজি। আমরা যদিও ভিটামিনে ভরা মিষ্টি
কুমড়ো খেয়ে থাকি অনেক মজা করে, কিন্তু অনেক সময় হয়তো না জেনেই এমন অনেক
খাবার খেয়ে থাকি যেগুলোর অনেক পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। আবার
হয়তো এমন অনেক খাবার আছে যেগুলোর আমরা উপকারিতা জানি না বলে সহজলভ্য হলেও
না খেয়ে অবহেলা করি। মিষ্টি কুমড়োর বীজ তেমনি একটি খাবার। এই খাবারটির
অবিশ্বাস্য স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। স্প্যানিশ একটি গবেষণার মতে মিষ্টি
কুমড়োর বীজ কিছু নির্দিষ্ট উপাদানে ভরপুর বলে এটি মানুষের মেজাজ ভাল রাখতে
সাহায্য করে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটি হচ্ছে তা হলো
ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
মিষ্টি কুমড়োর বীজের পুষ্টিমূল্য
মিষ্টি
কুমড়োর বীজে রয়েছে উচ্চ মাত্রার প্রোটিন, খাদ্য আঁশ, ম্যাঙ্গানিজ,
ম্যাগনেসিয়াম এবং ফসফরাস। এছাড়া এতে রয়েছে অনেক বেশী পরিমান জিংক যা
প্রতিরোধক ক্ষমতা বৃদ্ধিতে, উদ্দিপকের উন্নয়নে, কোষের সঠিক বিভাজনে, ঘুম
বাড়াতে, দৃষ্টিশক্তি, ত্বকের রঙ এবং মেজাজ ভালো করতে বেশ ভালো ভূমিকা রাখে।
এটি শারীরিক এবং মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের জন্যই খুবই উপকারী খাদ্য।
মিষ্টি কুমড়োর বীজের স্বাস্থ্য উপকারিতা
অনেক
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় পেয়েছেন যে এই বীজটির ক্যান্সারের কোষের বিরুদ্ধে কাজ
করার আশ্চর্য রকমের ক্ষমতা রাখে। বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসায়
মিষ্টি কুমড়োর বীজের বেশ সফলতা রয়েছে এবং এটির রয়েছে শক্তিশালী প্রদাহ
বিরোধী গুণাগুণ। জার্মান বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে, যেসব মহিলারা মেনোপজ
অবস্থায় থাকেন তারা যদি বেশি করে মিষ্টি কুমড়োর বীজ খান তবে তাদের স্তন
ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ২৩% কম থাকে। সূর্যমুখী বীজেরও একই ধরনের
গুণাগুণ রয়েছে। মিষ্টি কুমড়োর বীজের তেল প্রোস্টেট বড় হয়ে যাওয়ার চিকিৎসায়
বেশ কার্যকরী। এতে থাকে অনেক বেশি পরিমানে ফাইটোকেমিক্যাল এবং
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ফ্রি র্যাডিকেলের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং ক্যান্সার
কোষের বৃদ্ধি প্রতিহত করে। মিষ্টি কুমড়োর বীজ প্রোটিনের একটি চমৎকার উৎস যা
ওজন কমানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিউট্রিশনিস্টদের মতে ৩০ গ্রাম
মিষ্টি কুমড়োর বীজের প্রায় ৫ গ্রাম প্রোটিন থাকে। মিষ্টি কুমড়োর বীজ খেলে
অনেকক্ষণ পর্যন্ত পেট ভরে থাকার অনুভূতি থাকে। তবে সবশেষে যে কথাটি না
বললেই নয়, তা হচ্ছে মিষ্টি কুমড়োর বীজের অত্যন্ত উপকারিতা থাকলেও এটি
খাওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে এক সাথে অনেক বেশি পরিমাণে যেন খাওয়া না হয়।
খুব বেশি পরিমাণে খেলে ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে কারণ ১ কাপ মিষ্টি কুমড়োর বীজে
রয়েছে ২৮৫ ক্যালরি।
No comments:
Post a Comment