Thursday, October 26, 2017

কাঁঠালের পুষ্টিমান ও স্বাস্থ্য উপকারিতা

img-responsive

গ্রীষ্মকালীন ফলের মধ্যে কাঁঠাল অতিপরিচিত একটি ফল। এই ফলটি  জাতীয় ফল হিসেবেও খ্যাত। এর ইংরেজী
নাম (Jackfruit) । কাঁঠাল এক প্রকারের হলদে রঙের সুমিষ্ট ফল। বাংলাদেশের সর্বত্র কাঁঠাল গাছ কম-বেশি পাওয়া যায়। কাঁঠালের বৈজ্ঞানিক নাম Artocarpus heterophyllus । গ্রামবাংলায় কাঁচা কাঁঠালকে এঁচোড় বলা হয়। বসন্ত ও গ্রীস্মের প্রথমে কাঁচা অবস্থায় এবং গ্রীস্ম ও বর্ষায় পাকা অবস্থায় কাঁঠাল পাওয়া যায়। পাকা কাঁঠালে যেমন উপকার রয়েছে, তেমনি কাঁচা কাঁঠালও কম উপকারী নয়। কাঁচা কাঁঠাল আমিষ ও ভিটামিন সমৃদ্ধ তরকরি। এ ফলটি আকারে বেশ বড় হয়ে থাকে। এর পুষ্টিগুণ রয়েছে অনেক। কাঁঠালের ৪-৫ কোয়া থেকে ১০০ কিলো ক্যালরি খাদ্য শক্তি পাওয়া যায়। কাঁঠালে থাকা হলুদ রঙের কোষ ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধে ভরপুর । ২-৩ কোয়া কাঁঠাল আমাদের এক দিনের ভিটামিন ‘এ’ এর চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। সেজন্য কাঁঠাল অপুষ্টিজনিত সমস্যা রাতকানা এবং রাতকানা থেকে অন্ধত্ব প্রতিরোধ করার জন্য খুবই উপকারি ফল। গর্ভবতী এবং যে মা বুকের দুধ খাওয়ান তাদের জন্য কাঁঠাল অনেক দরকারি ফল। শরীরে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব দেখা দিলে ত্বক খসখসে হয়ে যায়।  হারিয়ে ফেলে সেক্ষেত্রে কাঁঠাল অনেক প্রতিরোধ করতে পারে। এ ছাড়া কাঁঠালের মধ্যে ভিটামিন ‘সি’ এবং কিছুটা ‘বি’ বিদ্যমান আছে। পাকা কাঁঠালের বিচি বাদামের মতো ভেজে খাওয়া যায়, সাথে তরকারি হিসেবেও খাওয়া যায়। ১০০গ্রাম কাঁঠালের বিচিতে ৬.৬ গ্রাম আমিষ ও ২৫.৮গ্রাম শর্করা আছে। সবার জন্যই আমিষ সমৃদ্ধ কাঁঠালের বিচি উপকারী। এজন্য কাঁঠাল গাছ বেশি লাগানো উচিত। সাথে বেশি করে কাঁঠাল ফলটি খেয়ে ভিটামিন ‘এ’- এর ঘাটতি পূরণ করা উচিত। কাঁঠাল গাছের কাঠ আসবাবপত্র তৈরীর জন্য ব্যবহৃত হয়। কাঁঠাল পাতা বিভিন্ন প্রাণীর পছন্দের খাদ্য। তুলনামূলকভাবে বিশালাকার এই ফলের বহির্ভাগ পুরু এবং কান্টকাকীর্ণ, অন্যদিকে অন্তরভাগে একটি কাণ্ড ঘিরে থাকে অসংখ্য রসালো কোয়া। কাঁঠালের বৃহদকার বীজ কোয়ার অভ্যন্তরভাগে অবস্থিত। এই সুস্বাদু ফলের কত যে উপকারিতা বিদ্যমান তা আসলে বলে শেষ করা যাবে না। চলুন তাহলে জেনে নেই কাঁঠালের আরও উপকারিতা সম্পর্কে।

কাঁঠালের স্বাস্থ্য উপকারিতা

১। কাঁঠালে চর্বির পরিমাণ অত্যন্ত কম। তাই এই ফল খাওয়ার কারণে ওজন বৃদ্ধির ঝুকি একদম কমে যায়।
২। কাঁঠাল পটাশিয়ামের উৎকৃষ্ট উৎস। ১০০ গ্রাম কাঁঠালে পটাশিয়ামের পরিমাণ ৩০৩ মিলিগ্রাম। পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। যাদের উচ্চ রক্ত চাপের সমস্যা আছে। তাদের জন্যে উচ্চ রক্ত চাপের প্রধান উপশম হবে এই কাঁঠাল। তারা নিশ্চিন্তে কাঁঠাল খেতে পারেন।
৩। কাঁঠালে প্রচুর ভিটামিন এ বিদ্যমান আছে। যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে।
৪। কাঁঠালের অন্যতম উপযোগিতা হল ভিটামিন সি। প্রাকৃতিকভাবে মানবদেহে ভিটামিন “সি” তৈরি হয় না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দাঁতের মাড়িকে শক্তিশালী করে ভিটামিন “সি”।
৫। কাঁঠালে বিদ্যমান ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস আলসার, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ এবং বার্ধক্য প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
৬। কাঁঠালে আছে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যা আমাদের দেহকে ক্ষতিকর ফ্রির‌্যাডিকেলস থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও আমাদেরকে সর্দি-কাশি রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে এই কাঁঠাল।
৭। টেনশন এবং নার্ভাসনেস কমাতে কাঁঠাল বেশ উপকারী ফল।
৮। অনেকের হজম এর সমস্যা থাকে। তাদের জন্য কাঁঠাল অনেক উপকারি। কারন বদহজম রোধ করতে  কাঁঠালের ভূমিকা অনেক।
৯। কাঁঠাল গাছের শেকড় হাঁপানী রোগের উপশম করে থাকে। এই কাঁঠালের শেকড় সেদ্ধ করলে যে উৎকৃষ্ট পুষ্টি উপাদান বের হয় তা হাঁপানীর প্রকোম নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।
১০। চর্মরোগের সমস্যা সমাধানেও কাঁঠালের শেকড় কার্যকরী। আবার জ্বর এবং ডায়রিয়া নিরাময় করে কাঁঠালের শেকড়।
১১। কাঁঠালে আছে বিপুল পরিমাণে খনিজ উপাদান ম্যাঙ্গানিজ। যা রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
১২। কাঁঠালে বিদ্যমান ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়ামের মত উপাদান হাড়ের গঠন ও হাড় শক্তিশালী করণে ভূমিকা পালন করে।
১৩। কাঁঠালে আছে ভিটামিন বি৬। যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
১৪। কাঁঠালে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম কেবল হাড়ের জন্য উপকারী নয় রক্ত সংকোচন প্রক্রিয়া সমাধানেও ভূমিকা রাখে।
১৫। ছয় মাস বয়সের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুকে কাঁঠালের রস খাওয়ালে শিশুর ক্ষুধা নিবারণ হয়। অন্যদিকে তার প্রয়োজনীয় ভিটামিনের অভাব পূরণ হয়।
১৬। চিকিৎসা শাস্ত্র মতে প্রতিদিন ২০০ গ্রাম তাজা পাকা কাঁঠাল খেলে গর্ভবতী মহিলা ও তার গর্ভধারণকৃত শিশুর সব ধরনের পুষ্টির অভাব দূর হয়।
১৭। গর্ভবতী মহিলারা কাঁঠাল খেলে তার স্বাস্থ্য স্বাভাবিক থাকে এবং গর্ভস্থসন্তানের বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়।
১৮। দুগ্ধদানকারী মা তাজা পাকা কাঁঠাল খেলে দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
১৯। কোষ্ঠকাঠিণ্য দূর কাঁঠালের তুলনা অসাধারন। কারন এই ফল আঁশালো তাই এতে কোষ্ঠকাঠিণ্য দূর হয়।
২০। কাঁঠালে রয়েছে খনিজ উপাদান আয়রন। যা দেহের রক্তাল্পতা দূর করতে সাহায্য করে।

কাঁঠালের বিচির পুষ্টিগুণ  ব্যবহার ও উপকারিতা

কাঁঠাল যেমন জনপ্রিয়, কাঁঠালের বিচি ও খুব জনপ্রিয় খাবার। চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গার সাথে কাঁঠালের বিচি মিশিয়ে ছোট মাছ দিয়ে রাঁধা তরকারি, শুটকি মাছের সাথে কাঁঠালের বিচি আর ডাঁটার তরকারি, মুরগি দিয়ে কাঁঠালের বিচি কিংবা কাঁঠালের বিচি ভর্তা এ রকম অসাধারণ সব স্বাদের খাবার তৈরিতে কাঁঠাল বিচির ব্যবহার নিশ্চয়ই আমাদের তেমন অজানা নয়। আলুর বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা এই খাদ্য উপকরণটি। আর এই উপকরণটির পুষ্টিমান সম্পর্কে আমরা কতটুকু বা জানি! যদি না জানা থাকে, চলুন আজ কিছুটা জেনে নেয়া যাক।

কাঁঠাল বিচির পুষ্টির পরিমাণ

প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁঠালের বিচিতে শক্তি পাওয়া যায় ৯৮ ক্যালরি। এতে কার্বোহাইড্রেট ৩৮.৪ গ্রাম, প্রোটিন ৬.৬ গ্রাম, ফাইবার ১.৫ গ্রাম, চর্বি ০.৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ০.০৫ থেকে ০.৫৫ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ০.১৩ থেকে ০.২৩ মিলিগ্রাম, আয়রন ১.২ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ২ মিলিগ্রাম, পটাসিয়াম ৪.০৭ মিলিগ্রাম রয়েছে। কাঁঠালের বিচি ভিটামিন বি-১ ও ভিটামিন বি-১২ এর ভালো উৎস। এ ছাড়া আছে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, থায়ামিন, নায়াসিন, লিগন্যান, আইসোফ্ল্যাভোন এবং স্যাপোনিনের মতো ফাইটো ক্যামিক্যালস।

কাঁঠাল বিচির স্বাস্থ্য উপকারিতা

১. কাঁঠালের বিচিতে থাকা এন্টি অক্সিডেন্টগুলো ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে অনেক ভূমিকা রাখে এবং বার্ধক্যের প্রভাব সৃষ্টিকারি উপাদানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
২. কাঁঠালের বিচিতে ফাইবার ও কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট বিদ্যমান। এর কারণে এর গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স কম। ফলে কাঁঠালের বিচি খেলে ওজন বাড়ে না। কিন্তু অনেক এনার্জি এই কাঁঠালের বিচি থেকে পাওয়া যায়।
৩. কাঁঠালবিচির প্রোটিন অত্যন্ত উপকারি। মাছ, মাংস যাদের কম খাওয়া হয় তাদের জন্য আমিষের চাহিদা মেটাতে কাঁঠাল বিচি উৎকৃষ্ট একটি খাবার।
৪. কাঁঠালবিচির জীবানুনাশক গুনও রয়েছে। এটি Escherichia coli I Bacillus megaterium ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে কাঁঠালের বিচি উপকারি এবং এতে থাকা বিশেষ উপাদান (Jacalin) এইডস রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নয়নে সফল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
৫. এতে থাকা পটাশিয়াম ব্ল্যাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।

কাঁঠালের বিচির আয়ুর্বেদিক উপকারিতা

১। কাঁঠালের বিচি বিপাক ক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
২। এটি হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
৩। কাঠালের বিচি হলো aphrodisiac অর্থাৎ এটি যৌন আনন্দ বাড়াতেও সাহায্য করে।
৪। ধারণা করা হয় কাঁঠালের বিচি টেনশন ও নার্ভাসনেস কাটাতে উপকারি।
৫। এ্যালকোহল জাতীয় মাদকের প্রভাব দূর করার জন্যও এর ব্যবহার রয়েছে।

কাঁঠালের ব্যবহার

কাঁঠাল কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। বসন্তকাল থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত কাঁচা কাঁঠাল কান্দা বা ইচোড়’ সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। পাকা ফল বেশ পুষ্টিকর, কিন্তু এর গন্ধ অনেকের কাছে ততটা আকর্ষণীয় নয়। তবু মৃদু অম্লযুক্ত সুমিষ্ট স্বাদ ও স্বল্পমূল্যের জন্য অনেকে পছন্দ করেন। কাঁঠালের আঁটি তরকারির সাথে রান্না করে খাওয়া হয় অথবা পুড়িয়ে বাদামের মত খাওয়া যায়। এর একটি সুবিধে হল, আঁটি অনেকদিন ঘরে রেখে দেয়া যায়। পাকা ফলের কোষ সাধারণত খাওয়া হয়, এই কোষ নিঙড়ে রস বের করে তা শুকিয়ে আমসত্বের মত ‘কাঁঠালসত্ব’ও তৈরি করা যায়। এমনটি থাইল্যান্ডে এখন কাঁঠালের চিপস্ তৈরি করা হচ্ছে। কোষ খাওয়া পর যে খোসা ও ভুতরো ( অমরা ) থাকে তা গবাদি পশুর একটি উত্তম খাদ্য। ভুতরো বা ছোবড়ায় যথেষ্ট পরিমাণে পেকটিন থাকায় তা থেকে জেলি তৈরি করা যায়। এমন কি শাঁস বা পাল্প থেকে কাচা মধু আহরণ করার কথাও জানা গেছে। কাঁঠাল গাছের পাতা গবাদি পশুর একটি মজাদার খাদ্য। গাছ থেকে তৈরি হয় মুল্যবান আসবাবপত্র। কাঁঠাল ফল ও গাছের আঁঠালো কষ কাঠ বা বিভিন্ন পাত্রের ছিদ্র বন্ধ করার কাজে ব্যবহৃত হয়।

No comments:

Post a Comment